একজন আবু জাফর

প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬ সময়ঃ ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ২:৩৪ অপরাহ্ণ

জাভিদ জাফর

12767613_1260608757299927_1020511270_nবাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একজন লেখক ও পন্ডিত হলেন আবু জাফর। তার সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি খ্যাতনামা। তিনি ছিলেন সত্যিকার একজন পুরুষ; ছিলেন কিছুটা অটল স্বভাবের প্রতিভাবান একজন সংস্কারক।
সংগ্রামী সাধারণ মানুষের জীবনের আবর্তন চক্র এবং সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট ও সংঘাতের অনবদ্য বর্ণনার ছাপ রয়েছে তার কর্মে। একজন অসাধারণ চিন্তক ও দার্শনিক ছিলেন তিনি। তার দৃষ্টিভঙ্গি খুব স্পষ্ট ও অনুমেয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন দারুণ একজন প্রবন্ধকার। একাধারে একজন পথিকৃৎ ও পথের দিশারি ছিলেন আবু জাফর।

এ অধ্যাপক ১৯৩৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) অর্জন করেন তিনি। ১৯৬০ সালে শেষ হয় তার মাস্টার্স। বিএল কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে শুরু হয় তার পেশাদারী কর্মজীবন। এরপর তিনি জগন্নাথ কলেজে চলে যান। সেখানে তিনি প্রায় এক দশক ধরে কাজ করেন।12735686_1260608887299914_660782046_n

শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিয়ে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাংলা সাহিত্যিকদের একজন, যার নাম সবচেয়ে সেরাদের নামের পাশে উচ্চারিত হয়। তার সবচেয়ে অসাধারণ চারটি বই হলো- অনিষ্ট জীবন (প্রবন্ধ সংগ্রহ), সাহিত্যে সমাজ ভাবনা, হাসান আজিজুল হকের গল্পের সমাজবাস্তবতা এবং রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা।

ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন ভীষণ মেধাবী। জীবনের সব ক’টি পরীক্ষায় তিনি প্রথম কাতারে ছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা বহু মৌলিক গবেষণাপত্র। দেশের বেশ ক’টি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখে যেতেন। অংশ নিয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক সভা ও সেমিনারে।

কবি মহাদে12735881_1260608803966589_1356369231_nব সাহা অধ্যাপক আবু জাফর স¤পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি ভীষণ শিক্ষিত ও জ্ঞানি, প্রগতিশীল ও উদারমনা একজন মানুষ। তার কুশলী ও চিন্তা-জাগানিয়া লেখনি আমাদের সাহিত্য জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। সে অনুযায়ীই, তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন খুবই নম্র ও ভদ্র।

প্রখ্যাত ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান একসময় অধ্যাপক আবু জাফরের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এটাও উল্লেখ করা উচিৎ, তিনি খুব ভালো আঁকিয়েও ছিলেন। হামিদুজ্জামান যখন চারুকলায় তার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী আয়োজন করেছিলেন, অন্তর্মূখী হওয়া সত্বেও আবু জাফর উদ্যোম নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। তার লাজুকতাকে সেদিন ছাপিয়ে গিয়েছিল শিল্পের প্রতি তার গভীর অনুরাগ।

হামিদুজ্জামান একবার তার বিষয়ে বলেছিলেন, ‘আবু জাফর ব্যক্তিতাবাদী, এবং খ্যাতি, অর্থ, স¤পদ ও প্রভাব নিয়ে মগ্ন মানুষদের জগত থেকে তিনি দূরে থাকতেন। যখনই জাতি কোন সঙ্কটময় অবস্থায় পতিত হয়েছে, তখন তিনি সামনে এগিয়ে এসেছেন। নিজের বুদ্ধিমত্তা ও পরামর্শ দিয়ে তিনি আমাদের সহায়তা করেছেন। আমরা সবসময় তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবো। বর্তমানে, তার অনুপস্থিতি আমরা ভীষণ অনুভব করছি।’1081707_1260608787299924_611279760_n

প্রচলিত কাঠামোর বাইরের দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতেন আবু জাফর। ফলে অনেকবারই ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের রোষানলে পড়তে হয়েছে তাকে। নিজের মনের কথা বলতেন তিনি। তার বই ছিল অনেক জনপ্রিয়। প্রচুর মানুষ সেসব পড়তো। তার দুইটি বই প্রকাশিত হয়েছে বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে। তবে বাজারে সেসব বই পাওয়া যায়নি। কারণ, ওই বইগুলো ছিল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সক্রিয় মানুষদের জন্য। এ ধরণের মানুষরা তার বই পড়তে পছন্দ করতো। আবু জাফরকে কখনও দেখা যায়নি নাম ও যশের পেছনে দৌঁড়াতে।

আমাদের একজন প্রখ্যাত প্রবন্ধকার, কলামিস্ট ও সমালোচক হিসেবে আবু জাফর সবসময়ই কাজ করতেন সতর্ক চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা নিয়ে। প্রতিটি প্রবন্ধে তিনি নতুনত্ব রাখতে চাইতেন। এভাবেই আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।

এটা সত্য যে, গবেষণাধর্মী কাজ আমাদের সাহিত্য জগতে তুলনামূলকভাবে খুবই কম। কিন্তু এ সত্যটা গোটা দুনিয়ার ক্ষেত্রেই খাটে। এ কারণেই উপন্যাস, ফিকশন বা ভ্রমণকাহিনী যতটা দেখা যায় বই মেলায়, সে হিসাবে গবেষণাধর্মী বই দুর্লভ বলা চলে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে আবু জাফরের লিখনী আমাদের সাহিত্যকে ভিন্ন মাত্রা দান করেছে। ১৯৯৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, শুধুমাত্র তার উৎসাহী অনুগামীরাই কেবল এই মাটির মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। জাতীয় পর্যায়ে এ ক্ষেত্রে তেমন কিছুই করা হয়নি।

প্রতিক্ষণ/এডি/শাআ

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

সর্বাধিক পঠিত

20G